টিকা কিভাবে কাজ করে



  • টিকা কিভাবে কাজ করে ?

    বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানীদের এক বিস্ময়কর আবিস্কার জিনিস হলো টিকা বা vaccine. টিকা আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক রোগ-প্রতিরোধ (immune system) ব্যবস্থার সাথে একসাথে কাজ করে অনেক ভয়ঙ্কর ও জীবনঘাতী রোগ-সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমাদেরকে সয়হাতা করেছে এবং করছে। এখানে ব্যাখ্যা করা হবে কিভাবে আমাদের দেহ থেকে বিভিন্ন রোগ সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং কিভাবে টিকা এ লড়াইয়ে আমাদেরকে শক্তিশালী ও কার্যকরী নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে।

    আমাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা—

    টিকার কার্যপদ্ধতি বোঝার জন্য আমাদেরকে আগে জানতে হবে কিভাবে আমাদের শরীর বিভিন্ন অসুখের বিরুদ্ধে লড়াই করে। যখন কোনো জীবাণু যেমন ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, তখন সেই জীবাণু আমাদের দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রমের উপর আক্রমন চালায় এবং একই সাথে নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি করে যেতে থাকে। এই ধরণের বহিরাক্রমণের ঘটনাকে বলা হয় সংক্রমণ (infection) এবং এই সংক্রমণ আমাদের দেহে বিভিন্ন ধরণের অসুস্থতার জন্য অনেকাংশেই দায়ী।

    এই ধরণের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমাদের দেহে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা। যেমন আমাদের রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা (leukocyte) আমাদের দেহের রক্ষক হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন ধরণের রোগ-সংক্রমণ দমনের জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। শ্বেত কণিকা রয়েছে মূলত তিন ধরণের- বি লিম্ফোসাইট (B-lymphocytes), টি লিম্ফোসাইট (T-lymphocytes) ও ম্যাক্রোফেজ (macrophages). এর বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়া হলো—

    ১. ম্যাক্রোফেজ- এটি দেহের মৃত কোষ গুলো ভক্ষণের পাশাপাশি রক্তে অনুপ্রবেশকারী বিভিন্ন জীবাণুদেরকেও ধ্বংস করে এবং রক্তে অ্যান্টিজেন (antigen) নামক বহিরাগত জীবাণুর কিছু অংশ সেখানে রেখে যায়। আমাদের শরীরে সেইসব অ্যান্টিজেন গুলোকে ক্ষতিকর ও বিপদজনক বস্তু হিসেবে সনাক্ত করে এবং এর প্রতিরোধের জন্য উদ্দীপনা যোগায়।

    ২. বি লিম্ফোসাইট- এর থেকে উৎপন্ন হয় অ্যান্টিবডি (antibody) এবং এই অ্যান্টিবডি ম্যাক্রোফেজের ফেলে রেখে যাওয়া অ্যান্টিজেনের উপর আক্রমণ চালিয়ে থাকে।

    ৩. টি লিম্ফোসাইট- এটি দেহের সংক্রমিত কোষ গুলোর উপর আক্রমণ চালায় এবং সেগুলোকে ধ্বংস করে থাকে।

    আমাদের শরীর যখন কোনো নতুন জীবাণুর সম্মুখীন হয় তখন সেই সংক্রমণের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কয়েকদিন থেকে শুরু করে সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। অতঃপর সংক্রমণের পর সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রক্রিয়া আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম সংরক্ষণ করে থাকে। পরবর্তীতে সেই জীবাণুটি যদি আবারও শরীরে অনুপ্রবেশ করে তবে টি লিম্ফোসাইট সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং রক্তে আবারও অ্যান্টিজেন উপস্থিত হলে বি লিম্ফোসাইট তার প্রতিরোধে কার্যকরী অ্যান্টিবডি তৈরী করে ও এর অবমুক্ত করে।

    টিকার কার্যপদ্ধতি

    টিকার প্রয়োগ দেহে এক ধরণের নকল সংক্রমণের সৃষ্টি করে এবং এ প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীরের রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়। এ ধরণের সংক্রমণ দেহে কোনো ধরনের অসুস্থতার সৃষ্টি না করলেও এটি দেহে টি লিম্ফোসাইট ও অ্যান্টিবডি তৈরিতে গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। তথাপি টিকা প্রয়োগের পর শরীরে কিছু ছোটখাটো রোগের উপসর্গ দেখা যায় যেমন হালকা জ্বর বা শরীরে ব্যাথা অনুভব হতে পারে। কিন্তু এগুলা অস্বাভাবিক কিছু নয় বরং টিকা প্রয়োগের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

    টিকার প্রকারভেদ–

    বিজ্ঞানীরা যেকোন ধরনের জীবাণুর সংক্রামণের বিরুদ্ধে টিকা তৈরির জন্য নানা ধরণের ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে। এই ব্যবস্থা গুলা নির্ধারিত হয় সেই জীবাণুর ধরণের উপর, যেমন সেই জীবাণুটি কিভাবে দেহের বিভিন্ন কোষকে আক্রমণ করে কিংবা দেহের রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা সেই জীবাণুর দ্বারা কি রকমভাবে প্রভাবিত হয়। এছাড়া টিকার আঞ্চলিক ব্যবহারও এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ জীবাণুর প্রকরণ (strain), পরিবেশ (যেমন তাপমাত্রা, আবহাওয়া), টিকার সরবরাহ অথবা ঝুকি ইত্যাদি এক এক অঞ্চলের ক্ষেত্রে এক এক রকম হয়। এসকল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মূলত পাঁচ ধরনের টিকা রয়েছে —

    ১. জীবিত কিন্তু দূর্বল টিকা (Live, attenuated vaccines)- এ ধরণের টিকা শুধু মাএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই টিকাতে কিছুটা দূর্বলকৃত কিন্তু জীবন্ত ভাইরাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ব্যবহৃত ভাইরাস দূর্বল হবার কারণে তা সরাসরি মানুষের দেহে কোনো অসুস্থতার সৃষ্টি করে না কিন্তু ভাইরাসগুলো জীবিত থাকবার কারণে দেহ এক ধরণের বাস্তব সংক্রমণের শিকার হয়।

    ফলে আমাদের রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা সেই দূর্বল সংক্রমণকে নিরীক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। হাম (measles), মাম্পস (mumps), রুবেলা (rubella), চিকেনপক্স (chickenpox) ইত্যাদির প্রতিরোধে এই ধরণের টিকা ব্যবহৃত হয়। এই ধরণের টিকা ব্যবস্থা খুবই কার্যকরী হলেও সবাই এটি গ্রহণ করতে পারে না, বিশেষ করে বাচ্চারা যাদের রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা দূর্বল (যেমন যারা কেমোথেরাপি নিচ্ছে) তাদের জন্য এটি মোটেই উপযোগী নয়।

    ২. নিষ্ক্রিয় টিকা (­Inactivated vaccines)- এই ধরণের টিকাও ভাইরাস দ্বারা সংগঠিত সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই টিকা তৈরীর সময় ভাইরাসকে একেবারে নিস্ক্রিয় অথবা মেরে ফেলা হয়। পোলিও টিকা হলো এই ধরণের টিকার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে পোলিও ভাইরাস কে একেবারে নিস্ক্রিয় করে টিকা প্রস্তুত করা হয়। এই টিকা ক্ষেত্রে রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখবার জন্য অনেক সময় একাধিক ডোজ এর প্রয়োজন হতে পারে।

    ৩. টক্সয়েড টিকা (Toxoid vaccines)- ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংগঠিত রোগ প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার হয় এই ধরণের টিকা। এই টিকা প্রস্তুতিতে বিষকে (toxin) দূর্বল করে ফেলা হয় যাতে তা কোনো অসুস্থতার সৃষ্টি করতে না পারে। এই দূর্বলকৃত বিষকে বলা হয় টক্সয়েড। শরীর যখন এই ধরণের টিকা গ্রহণ করে তখন শরীর বুঝতে পারে কিভাবে সেই বিষটিকে প্রশমন করতে হবে। এই টিকার একটি উদাহরণ হলো DTaP টিকা যাতে ডিপথেরিয়া ও টিটেনাস এর টক্সয়েড রয়েছে।

    ৪. সাবইউনিট টিকা (Subunit vaccines)- এই টিকার প্রস্তুতিতে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার অংশবিশেষ ব্যবহৃত হয়। কারণ এই টিকা গুলো সম্পূর্ণ জীবাণুর পরিবর্তে কেবল প্রয়োজনীয় আন্টিজেন গুলোই বহন করে। তাই এতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তুলনামূলক ভাবে কম দেখা যায়। হুপিং কাশির (pertussis) টিকা প্রস্তুতিতে এই পন্থা অবলম্বন করা হয়।

    ৫. অনুবন্ধী টিকা (Conjugate vaccines)- বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে এই টিকার ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে যেসব ব্যাকটেরিয়ার আন্টিজেন এর চারপাশে পলিস্যাকারাইড এর আবরণ রয়েছে। এই ধরনের আবরণ থাকবার জন্য শরীরের রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা সহজে সেই আন্টিজেন টিকে সনাক্ত করতে পারে না। তাই এর প্রতিউত্তর সরূপ আন্টিবডি তৈরীও কঠিন হয়ে দাড়ায়। এই টিকাগুলো পলিস্যাকারাইড ও আন্টিজেন এর মাঝে এক ধরণের অনুবন্ধী সম্পর্ক স্থাপন করে, যার ফলে শরীরের রোগ-প্রতিরোধক ব্যবস্থা খুব সহজেই এটিকে সনাক্ত করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা মূলক ব্যবস্থা নেয়। Haemophilus influenzae type B ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংঘটিত রোগ প্রতিরোধের জন্য হিব (Hib) টিকা প্রস্তুতিতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

    এখান থেকে আরোও পড়ুন

    সূর্যের রং কি?
    মহাবিশ্বের কি সীমানা আছে?
    মহাবিশ্বের আকৃতি আসলে কেমন?

    বিজ্ঞান - Biggan.Info


Log in to reply